“হাবজি গাবজি” চলচ্চিত্র ও ভিডিও গেম সম্পর্কিত দুই চারটি কথা

As part of DiGRA India’s Indian vernacular languages posts, Achintya Debnath writes about the recent Bengali movie Habji Gabji (2022). The main theme of the movie, Debnath writes, revolves around the unscientific and misinformed understanding that playing video games causes violent behaviour, negatively impacts powers of concentration and leads to brain damages. Debnath argues that on the basis of long academic research on the field, violent content and issues in video games do not affect how people act; rather, violent actions that may appear to be inspired by videogameplay depends on a complex network involving many other primary factors such as psychological and social environment, perspectives, mental state, ability of consuming facts critically, amid other salient factors.

[The Author’s opinions are his own and in no way represents DiGRA India’s]

উত্তম-সুচিত্রা, সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন প্রমুখেরা ইহলোক হইতে অন্তর্ধান করিলে বাংলা চলচ্চিত্রের যে ক্ষত হইয়াছিল তাহা কোন ব্যান্ডেজ দিয়াই আবৃত করা যায় নাই। তাঁহাদিগের পরে যে বস্তাপচা সিনেমা আর পটের অভিনয় শুরু হইয়া ছিল যাহার নিমিত্ত মধ্যবিত্ত বাঙালি সিনেমাহলে গিয়া সিনেমা দেখা বন্ধ করিয়াছিল পরিণতিতে সিনেমাহল গুলির চোদ্দটা বাজিয়া ছিল, সেই ধারায় কিছু ছোট বড় ছেদ পড়িলেও আজও তাহা অব্যাহত (যাহার সর্বাপেক্ষা জলন্ত দৃষ্টান্ত বাংলা টিভি সিরিয়াল গুলি)। অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ, সৃজিত প্রমুখেরা শত চেষ্টা করিয়াও সেই ছেদ দীর্ঘস্থায়ী করিতে পারে নাই। তবে আশা যে চিরতের ক্ষীণ হইয়াছে তাহা কহিব না কারন অতিসম্প্রতি বাংলা ওয়েব সিরিজ বলিয়া কিছু বাহির হইতেছে আর আশার আলো দেখাইতেছে। যাহাহোক আমি অদ্যস্থানে বাংলা সিনেমা জগতের ইতিহাস লিখিতে বসি নাই, সুতরাং এই সব বিষয়ে বাতুলতাও করিব না। কিন্তু যে চলচ্চিত্র সম্পর্কে লিখিব তা গতানুগতিক ধারার অন্যতম পরিচিত পরিচালকের ছবি। অনুমান করুন কে?     

  এতটুকও অনুমিত হয় না, তাহা হইলে আপনি বাঙালি নন অথবা বাংলা ছবি দেখেন না, কে আবার আমাদিগের রাজ চক্রবর্তী। তাঁহারই পরিচালিত হাবজি গাবজি চলচ্চিত্র। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য তিনি উপরোক্ত ধারার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার একজন হিতৈষী, যদিও আলোচ্য স্থলে তিনি সেই ধারা হইতে বিচ্যুত হইয়া হিতৈষী পদ খোয়াইয়াছেন এবং নতুন ধরনের কিছু লইয়া নতুন কিছু দেখাইবার প্রচেষ্টাই করিয়াছিলেন, অন্তত আমার তাহাই মনে হয়। হাবজি গাবজি সিনেমা নিমত্ত তিনি যে একখানি সামাজিক বার্তা উপদেশ (যাহা তিনি মহৎ ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বলিয়া) অপামর বাংলায় দিবেন তাহা অতিউত্তম! দেখা যাউক তিনি কি করিয়াছে। যে সৎকর্ম-সারমর্ম, প্রাসঙ্গিকতা ও মহৎ উদ্দেশ্য নিয়া তিনি হাবজি গাবজি তৈয়ারি করিয়াছেন সেই সম্পর্কে আমার কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু গণ্ডগোল বাধিল ওইখানেই, তাঁহার মূল উদ্দেশ্যেই, তাহা মহৎ, প্রাসঙ্গিক, সৎ-সারমর্ম কিনা তাহা তিনি যাচাই না করিয়াই স্থির করিলেন যে তা মহৎ। অর্থাৎ গোদা বাংলায় তিনি কোনরূপ গবেষণা অথবা এই বিষয়ে অভিজ্ঞ কাহারও সহিত কোন আলোচনা ছাড়াই এই কর্মটি মহৎ বিশেষণে ভূষিত করিয়াছেন এবং যা হবার তাই হইয়াছে মানে উদর পিণ্ডি বুধোর কাঁধে চাপাইয়াছেন।   

  প্রথমেই যে জিনিস খানি আমার সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছে তা হইল চলচ্চিত্রের নামখানি। ইহার সহিত যে ডিগবাজির খুব ছন্দগত মিল পাইতেছি তাহাই নহে ব্যাকরণের অর্থও আলোচ্য স্থলে ডিগবাজি খাইতেছে, কারন ইহার ব্যাকরণগত কোন অর্থ নাই। হাবজি গাবজি নাম খানি দেখিয়াই হযবরল এর হিজবিজবিজের কথা স্মরণে আসিল কিন্তু তাহার সহিত ভিডিও গেমের কোন সম্মন্ধ নাই, তাই আরও কিছুক্ষন চিন্তা করিলে এই কালের ভিডিও গেম পাবজি র কথা মনে আসিল, কিন্তু ইহার তো পুরা অর্থ রহিয়াছে তাহা হইল Players Unknown battle ground। সুতরাং পরিচালক যে পুরদস্তুর ভাবনা চিন্তা না করিয়া চলচ্চিত্রের অর্থহীন নাম রাখিয়াছেন তা এক কথায় সবাই মানবেন। অর্থ না থাকিলেই যে অনর্থ হইবে তাহা আমি স্বীকারে অপ্রস্তুত, তবে তাই বলিয়া যে সর্বদাই আমি অস্বীকারে প্রস্তুত তাহাও নহে। যাহাহোক, আমার স্বীকার/অস্বীকার সকলই আমার নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপার ইহা লইয়া অনাবশ্যক চর্চা অদ্যস্থানের বিষয় নহে। যে বিষয়ের চর্চা করিব তা হইল ভিডিও গেম সত্য সত্যই কি মানসিক বিকার গ্রস্থ হইতে সহায়তা করে? “হাবজি গাবজি” চলচ্চিত্রে যাহা দেখানো হইয়াছে হইতেছে তাহা কি বিজ্ঞান সম্মত? হইলেও কতখানি?  

  প্রথম প্রশ্নের উত্তরের জন্য প্রয়োজন ভিডিও গেম বিষয়ে গবেষকদের যাবতীয় বিজ্ঞান সম্মত চর্চার উপর আলোকপাত করা। এই বিষয়ে তাবড় তাবড় গবেষকগণ বিদেশি ভাষায় বহু পুস্তকাদি, আলোচনা সমৃদ্ধ বিজ্ঞান সম্মত পত্র-পত্রিকা বহির করিয়াছেন এবং এখনও করিতেছেন। তাঁহাদিগের বিশাল কার্যকলাপ সম্পর্কে এই সীমাবদ্ধ স্থানে বিস্তারিত আলোচনা অসম্ভব, উপরন্তু “হাবজি গাবজি” একখানি বাংলা চলচ্চিত্র। তাই অদ্যস্থানে আমি কেবলমাত্র বাঙালি গবেষকগনের মতামতের উপর নির্ভর করিবার প্রয়াস করিব। এইদিক হইতে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব ও সি.এস.এস.এস.সি র বর্তমান অধ্যাপক ও গবেষক সৌভিক মুখার্জির মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য।[1] তিনি যে কেবল এই পর্যায়ভুক্ত অবৈজ্ঞানিক চলচিত্রের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সোচ্চার তাহাই নয়, তাঁহার মতে আলোচ্য চলচিত্রটি  কোনরকম বিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষণার উপর নির্ভরশীল নয় বরং তা ভিত্তিহীন জটিল যুক্তির উপর এক অতিসরলীকৃত নির্মীয়মাণ। তাঁহার মতে একদা চলচিত্রকেই ক্ষতিকর বলে মনে করা হত যা এখন ইতিহাসের বিষয় এবং তাহারও পূর্বে বঙ্কিমের উপন্যাস পড়াকেও জনসাধারণের পক্ষে ক্ষতিকারক বলে মনে করা হইত।

  চলচ্চিত্রের শুরুতেই দেখা যায় ছোট্ট টিপু ওরফে অনিস বাসুকে, তার বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে বাবা আদিত্য বাসু নিজের দায়িত্ব এড়াতে হাতে তুলে দেন মোবাইল ফোন আর ফোনের ভীতরকার ভিডিও গেম। এরই পরিণতি হিসাবে টিপুর মানসিক পরিবর্তন তথা মস্তিষ্ক বিকার গ্রস্থ হবার ঘটনাহীন ঘ্যানঘ্যানানি-প্যানপ্যানানি চলচিত্রের মূল বিষয় বস্তু। বার বার হাজার বার এই একই টিপুর মস্তিষ্ক বিকার আর তাহার পশ্চাতে ভিডিও গেম খেলার কারন অকারনে প্রদর্শিত হইয়াছে সমস্ত সিনেমা জুড়িয়া। যদিও টিপুর মস্তিষ্কগ্রস্থ হইবার কোন বিজ্ঞান সম্মত ব্যাখ্যা পরিচালক উপস্থাপন করিতে গুরুতর ভাবে ব্যর্থ হইয়াছেন কারন জটিল মনস্তত্ত্বের সুক্ষ বিচার-বিশ্লেষণের কোন অবকাশ পরিচালক পাননি তাহা সিনেমাটি দেখিলেই বোঝা যায়। শুধু তাহাই নহে পরিচালক নিজে চিকিৎসা বিজ্ঞানে তাঁহার পাণ্ডিত্যকে জাহির করার নিমিত্ত এই উক্তি চলচিত্রের ডাক্তারমশাইকে দিয়া করাইয়াছেন যে ভিডিও গেম খেলিলে মস্তিষ্কের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ আয়তনে ছোটো হইয়া যায় এবং মনোসংযোগ করিতে বাঁধা প্রাপ্ত হয়। এইমত যে কেবলমাত্র হাস্যকর তাহাই নহে ইহা প্রমান করে যে সামাজিক সদুপদেশ দেবার নিমিত্ত কোন চলচিত্র পরিচালককে যে পরিমাণ গবেষণা ও পরিশ্রম করিতে হয় তাহার কানাকড়িও আলোচ্য চলচিত্রে পরিচালক করেন নাই। তবে টিপুর চক্ষুর ক্ষতি হইবার বিষয়টি গুরুতর সত্য, এই বিষয়ে পরিচালক জোর দিতে পারিতেন কিন্তু তা না করিয়া তিনি অহেতুক প্যাঁচালি পারিয়াছেন। সামাজিক বার্তার নিমত্ত নির্মিত আলোচ্য সিনেমাটিতে কোনরকম এন্টারটেন্টমেন্ট নাই ভীষণরকম একঘেয়ে যদিও সেই সামাজিক বার্তা ও সদুপদেশ দিতেও ইহা চরম ভাবে ব্যর্থ।      

  বলাই বাহুল্য যে “হাবজি গাবজি” পরিচালক ভিডিও গেম বিষয়ক গবেষণা ও গবেষক সম্পর্কে অভহিত নন। এই বিষয়ে তাহার সম্পূর্ণ অজ্ঞানতা, অবৈজ্ঞানিক মতামত ও পরিচালনা তাহার অদূরদর্শিতাকেই প্রতিভাত করে, যদিও তাঁহার পরিচালক হিসাবে কৃতিত্বকে নয়। প্রসঙ্গত স্মর্তব্য যে, রেলপথ যখন ভারতবর্ষে আসিয়াছিল সেই কালের বিখ্যাত নবদ্বীপের পণ্ডিতকুল তাহা বর্জনীয় বলিয়া ঘোষণা করিয়াছিল, (তাঁহাদিগের যুক্তি আলোচ্য চলচিত্রের অপেক্ষা কম ভয়ঙ্কর ছিল না, যে পথ তিন দিনে যাইতে হয় তাহা যদি তিন ঘণ্টায় যাওয়া যায়, তাহা হইলে সেই যাওয়ায় মনুষ্য আর মনুষ্য রহিবে না তাহা প্রেতাত্মায় পরিণত হইবে) ইহা তাঁহাদিগের অদূরদর্শিতাকেই প্রতিভাত করিয়াছিল, পাণ্ডিত্যকে নয়।

  চলচ্চিত্রটির একটি অন্যতম দাবী হইল যে এটি ভীষণ প্রাসঙ্গিক। আর এর নিমিত্ত ইহার বহু প্রশংসাও করা হইয়াছে। একখানি বাংলা পত্রিকায় এর প্রাসঙ্গিকতার ভুরি ভুরি জলন্ত দৃষ্টান্ত দেওয়া হইয়াছে। প্রাসঙ্গিকতার সূত্রে দুই কথা বলি, শোনো গত বৈশাখ মাসের প্রখর রৌদ্রে পি.এস.সি র এগজাম দিতে গিয়াছিলাম, তথায় দেখি রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো ষ্টেশনের বাইরে এই ফুটিফাটা কাঠপোড়া রৌদ্রে এক বুড়া আর এক বুড়ী রাস্তার মধ্যে পরিয়া রহিয়াছে, যখন ফিরিতে ছিলাম দেখিলাম বুড়ী একবাটি পচাপান্তভাত নুন লঙ্কা দিয়া খাইতেছে। অস্পৃশ্যতা হইতে ঘৃণ্য, কুলীন প্রথা হইতে জঘন্য, সাম্প্রদায়িকতা হইতে মারাত্মক এই “বস্তিবাসীজাতি” ব্যবস্থা আমাদিগের দেশের কলঙ্ক উলঙ্গ ভাবে বিশ্ববাসীর নিকট উন্মোচন করিতেছে, ইহা কি প্রাসঙ্গিক নয়? প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্ন নিয়া আমি আর বড় কিছু কহিব না, কিন্তু দোহাই তোমাদিগকে যাহারা প্রাসঙ্গিকতা লইয়া “হাবজি গাবজি” বানাইয়াছ আর বেশি কিছু ঘাঁটাইয়ো না।

  যাহাহোক কালের সাক্ষী হইয়া ইতিহাস সকলের কানে কানমলা দিতেছে আর কহিতেছে নতুন জিনিস নতুন জ্ঞান নতুন তথ্য সকলই সকল কালের কুশলীরা ত্যাগ করিতে কহিয়াছে। ইহা দার্শনিক সত্য ইহা ঐতিহাসিক সত্য। এ জগতে প্রতিটি জিনিসেরই মন্দ দিক ও ভালো দিক বর্তমান ইহা সকলের গোচর একটি অতি পরিচিত অপরিবর্তনীয় বিষয় যা যুগ যুগ ধরিয়া, কালের পর কাল অপরিবর্তিত রহিয়া গেছে।       


[1] এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে তাঁর বইখানি পড়তে পারেন। এছাড়াও তিনি নানান গবেষণা পত্র বাহির করিয়াছেন। এই সকল গবেষণা পত্রে তাঁর সুগভীর চিন্তার প্রতিফলন পেতে পারেন ভিডিও গেম বিষয়ে।

—অচিন্ত্য় দেবনাথ

লেখক কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ কালচারাল স্টাডিজের পি.এইচ.ডি গবেষক

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: